খুনি

বেসিনের কল থেকে পানি পড়ছে অবিরত।
সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিসা।
ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছেনা ওর।
এ কিভাবে সম্ভব?



ও এটা কিভাবে করতে পারলো??
আচ্ছা!! সত্যিই কি কাজটা ও করেছে??
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তো সব ঠিকই
ছিলো!
তাহলে কিভাবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর ওর জানা নেই। আয়নাতে নিজের
চেহারা একবার দেখে নিলো।চোখ ফুলে উঠেছে।
লালচে ভাব চোখে।
কান্না করার ফল।
বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না।
বলতে গেলে ভয় পাচ্ছে।বের হলেই সেই দৃশ্য!!!
উফ!!!
নাহ!! আর ভাবা যায়না!!!
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।আঁতকে উঠে আরেকটু
হলেই বেসিনের পাশে রাখা তাক থেকে সব
ফেলে দিতে নিয়েছিল রিসা।
ভয়ে সারা শরীর কঁপছে ওর।
পাশের ঘরে ফোনটা বেজেই চলেছে।
কেটে গেল লাইন।
হাফ ছেড়ে বাঁচলো রিসা।
কিন্তু তা বেশিক্ষণের জন্য না।
আবার বাজতে শুরু করেছে ফোন।
ভয়ে আয়নায় তাকিয়ে আছে রিসা। কলটা বন্ধ করলো।
এখন বাথরুমে নীরবতা।
শুধু রিসার নিঃশ্বাসের শব্দ।
বুকের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ ঢোল বাজাচ্ছে।
ধ্রিম!! ধ্রিম!! ধ্রিম!!
ফোনটা থেমে গিয়েছে।
সব চুপ।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
ঝট করে পেছনে তাকালো রিসা।
এখন আর বাথরুমে থাকা যাবেনা।
কিছু একটা করতে হবে।
তাড়াতাড়ি বাইরে বের হয়ে এলো। ভেজা পা ওর।সেই
ভেজা পায়ে হেটেই দরজার কাছে গেল।
আই হোলে তাকালো বাইরে।
বাইরে তো কাওকে দেখা যাচ্ছেনা।
কে এসেছিল??
দরজা খুলে বাইরে বাইরে গলা বাড়িয়ে তাকালো।
আশেপাশে কেউই তো নেই।
তার মানে ওর মনের ভুল!
দরজাটা লাগিয়ে রুমের ভেতরে গেলো রিসা।বেড রুমের
দরজাটা হালকা খোলা।
সেখানে এসে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলো।
এবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো।
ভেতরের বিছানায় তাকাতেই ওর পেটের ভেতর মোচড়
দিয়ে উঠলো।
মাথা ঘুরছে।
বিছানায় একটা মেয়ে শুয়ে আছে।
ঘুমন্ত।
গতকাল রাত পর্যন্ত মেয়েটার এই ঘুমন্ত মুখ
মায়া তৈরী করতো মনে।
তবে এখন এটা একটা বিভীষিকা হয়ে গিয়েছে।
মুখটা হা করে খোলা,, চোখদুটোর জায়গায় গর্ত।পেট
হতে গলা পর্যন্ত চেরা।ভেতরের নাড়ীভুঁড়ি বের
হয়ে বিছানার সাথে লেগে আছে। কিছু কিছু অন্ত্র
টেনে বের করা হয়েছে।তাই কেমন যেন
খাপছাড়া ভাবে সেগুলো বের হয়ে আছে।হাতের প্রায়
সব
আঙুলই কাটা।তবে সব গুলোই আছে বিছানায়। এক
পাশে।
মুখের ভেতর কাপড় গোজা।তাই শব্দ
করতে পারেনি বেচারি। হাতে কালশিটে দাগ
দেখে বোঝা যাচ্ছে হাত বাঁধা ছিলো।মারার পর
খুলে ফেলা হয়েছে।
পুরো বিছানায় রক্ত লেগে আছে।শুকিয়ে প্রায়
কালচে হয়ে গিয়েছে।
আর দেখা যায় না!
ছুটে বের হয়ে এলো রিসা।
ভয়ে কাঁপছে।
গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।
পানি গ্লাসে ঢেলে ঢক ঢক করে গিলে ফেললো।আবার
মনে ভয় কাজ করছে।
কি করবে? কাকে বলবে?
কেউই বিশ্বাস করবেনা ওকে।
সবাই ভাববে ওই খুন করেছে শান্তাকে।
আর অন্যকে বলে কি লাভ?
ও নিজেই তো বিশ্বাস করছেনা নিজেকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি নিজের হাতে কেউ রক্ত
মাখা ছুরি দেখে আর অন্য হাতে অন্ত্র
ধরে রেখেছে এই
দৃশ্য দেখে তাহলে নিজে কতোটা নিরপরাধ
তা একটা ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়ায়।শুধু ভাবনা নয়।
আতংকও বটে।
আর থাকতে পারলোনা রিসা।
জ্ঞান হারালো।
লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
কতক্ষণ এভাবে ছিলো জানেনা রিসা। জ্ঞান
ফিরে দেখলো চারিদিকে সাদা।কোথায়
আছে বুঝতে পারছেনা ও।
ঘাড় ফেরানোর চেষ্টা করলো,,দরজায় পুলিশ পাহারায়
দেখে ওর ভেতরে আবার ভয় শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু
কিসের ভয় তা ঠিক মনে পড়ছেনা।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে পড়ে রইলো।
তারপর দেখলো একজন ডাক্তার ঘরে ঢুকছেন।
সাথে পুলিশের পোষাক পড়া একজন অফিসার।
-"এখন কেমন বোধ করছেন মিস রিসা? ",ডাক্তার
হাসিমুখে জানতে চাইলো। হাসিটা কৃত্রিম। বোঝাই
যাচ্ছে।
-"জ্বি, ভালো.... কি হয়েছিল আমার ডক্টর?
",রিসা উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস
করলো।
-"শান্তা নামের কাওকে চিনেন মিস রিসা?
",পাশে দাড়ানো অফিসার জিজ্ঞেস করলো।
হাতে ভর দিয়ে বসতে গিয়েও তাল
হারিয়ে ফেললো রিসা।
প্রায় পড়েই যাচ্ছিল।
ডাক্তার ধরে ফেলায় রক্ষে।
-"শা.......শা.....শান্তা!!",তোতলাচ্ছে রিসা।
-"শান্তার বাসায় আপনাকে পাওয়া গিয়েছিল। অজ্ঞান
অবস্থায়।",অফিসার ঘোষনা দিলো যেন।
-"আসলে.... আ....আসলে..... শুনুন প্লিজ!!
",শান্তার
কন্ঠে আকুঁতি।অফিসার রিসাকে থামিয়ে বললো শান্তা হত্যার ব্যাপারে আপনার কাছে থেকে কিছু তথ্য চাচ্ছি আমি।
এই মুহূর্তে রিসা অবাক আর নির্বাক দুটোই
হয়ে আছে।
ওর হাতের ছাপ ছুরিতে আছে, ওর হাতে কিছু অস্ত্র ছিলো।
যেটা ও নিজের বিছানাতেই ফেলে দিয়েছিল।তা কি এরা খুঁজে পায়নি?
যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই পরের
কথাটা বললো অফিসার, "আপনার ঘরে যে ছুরি আর যা যা পাওয়া গিয়েছে,সেগুলো মিস শান্তার নয়।"
রিসা হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে।
ওকে আরো অবাক করে দেয়ার জন্যই অফিসার পরের
কথাটা বলল, "ওগুলো নকল ছিলো।রক্ত এবং অস্ত্র দুটোই ৷"
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রিসার।
শোনা যায়না এমন স্বরে বললো,"নকল মানে? "
অফিসার বলল, "আমরা টেস্ট করেছি।
সেখানে ধরা পড়েছে এগুলো শান্তার নয়।
রক্ত আর অন্ত্র দুজন ভিন্ন মানুষের শরীর
থেকে নেয়া।কার সেটা অবশ্য এখনো বের
করতে পারিনি।তবে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। এখন
আপনি একটু বলবেন কি শান্তা আপনার কি হয় আর
শান্তার ব্যাপারে আপনি কি কি জানেন?"
এই মুহূর্তে রিসার চোখে তাকিয়ে আছে অফিসার।
তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছে ওকে।
একটু সময় নিয়ে বললো রিসা,"শান্তা আর আমি একই
কলেজে পড়েছি।ওর সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ তখন
থেকেই। ঢাকায় ও একাই থাকে।ওর মা-বাবা কেউ
নেই।খালার কাছে থেকে পড়াশুনা করতো।
খালা মারা যাবার পর থেকে ও একাই থাকে।
আমি ঢাকায় একটা ছোট্ট কাজে এসেছিলাম।
এখানে আমার পরিচিত তেমন কেউ নেই তাই ওর
বাসায় ওঠা।"
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো রিসা।
অফিসার এখনো তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
-"আপনি ঠিক জানেন তো! ওর আপন কেউ নেই?
বা ঢাকায় ও একাই থাকে? ",অফিসারের প্রশ্ন।
-"আমি যতোটুকু জানলাম তাই বললাম। ",রিসার কথায়
কোনো জড়তা নেই।মানে সত্যি বলছে।
-"ঢাকায় আপনার কি কাজ ছিলো সেটা কি বলবেন
প্লিজ? "
-"চাকরীর ইন্টারভিউ ছিলো।তাই এসেছিলাম।ওর
বাসাতে থাকবো আর ইন্টারভিউ দিয়ে কিছুদিন
ঘুরবো। এই উদ্দেশ্য ছিলো আমার।"
-"গতরাতে ঠিক কি হয়েছিল সেটা সম্পর্কে একটু
বলবেন? "
-"গতরাতে আমি আর শান্তা একসাথে খাওয়া-
দাওয়া করে কিছুক্ষণ গল্প করি।তারপর ঘুমাতে যাই।
তারপর আমি আর কিছুই জানিনা অফিসার।
সকালে উঠে....... "
মুখটা ঢেকে কান্না করছে রিসা।
এবার ডাক্তার কথা বলে উঠলো,"অনেক
কথা হয়েছে অফিসার।আর নয়।এবার আমার পেশেন্ট
রেস্ট নিবে। "
অফিসার আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
-"আচ্ছা আপনার সাথে পরে কথা হবে। সে কয়দিন
একটু
কষ্ট করে আপনাকে ঢাকাতেই থাকতে হবে।বুঝতেই
পারছেন।আপনার থাকার ব্যাবস্থা করার
চেষ্টা করছি।আসি।"
অফিসার বের হয়ে গেল।ডাক্তারও বের হয়ে গেলো।
যাওয়ার আগে নর্মাল চেকআপ করে নিল।
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলো রিসা।
আসলেই কি শান্তার কেউ নেই?
কেউ নেই?
** **
নিজের অফিসে বসে ভাবছে অফিসার নীল।পুলিশ
ডিপার্টমেন্টে তার আলাদা নাম-ডাক আছে।পাঁচ
বছরের চাকরী জীবনে প্রায় প্রতি কেসেই
সে জিতেছে। তবে এবারের কেসটা আলাদা।
কোনো ক্লু নেই।
প্রথমে স্বাভাবিকভাবে রিসাকে সন্দেহ হলেও
পরে বুঝতে পারে আসলে ব্যাপারটা সাজানো।
কোনো ঠান্ডা মাথার খুনিই এভাবে খুন করতে পারে।
আর সবচেয়ে বড় কথা শান্তার কেউ নেই সেটা নীলও
জানে।খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছে সে।ভাই-বোন,মা-
বাবা কেউই নেই।খালা মারা যাবার পর
শান্তা একাই থাকে।
সেক্ষেত্রে রিসা শান্তাকে খুন করে খুব সহজেই
পালাতে পারতো।ধরার কোনো উপায় ছিলো না।
কিন্তু তা সে করেনি।
ডাক্তার এর সাথে কথা বলে জেনেছে অতিরিক্ত
ভয়ের
কারণে রিসা জ্ঞান হারায়।
আর আজ কথা বলার সময় রিসার মুখের ভাব দেখেই
বুঝেছে কাজটা আর যাই হোক এই মেয়ের না।
আর যদিও এই মেয়ের হয় তাহলে এই মেয়ে খুব
পাকা অভিনেত্রী।
চেয়ারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে পা-
টা টেবিলে উঠিয়ে দিয়ে মাথার
পেছনে হাতটা রাখলো নীল।
পা নাচাচ্ছে আর
ভাবছে।
আজ অথবা কাল শান্তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
আসবে হাতে।
তারপরই বোঝা যাবে আসলে কি হয়েছিল।
লাশের কথা ভাবতেই কেমন যেন
গা গুলিয়ে এলো নীলের।
এভাবে মানুষ
মারে কিভাবে?!
-"স্যার!! আসতে পারি? ",দরজায়
দাড়িয়ে আছে একজন।
নীলের সহকারী।
অফিসার সময়।
নীলের চেয়ে একটু নিচের পোস্টে আছে।
নতুন।
তাই প্রত্যেক কাজেই আগ্রহ খুব বেশি।
পা-টা টেবিল থেকে নামিয়ে নিলো নীল।
-"আসো সময়!"
ভেতরে ঢুকলো সময়।
-"বসো। ",নীল সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললো।
চেয়ারটা টেনে বসলো সময়। হাতে একটা ফাইল
দেখা যাচ্ছে।
-"কিসের ফাইল ওটা? ",নীল ইঙ্গিতে জানতে চাইলো।
-"স্যার এটাতে শান্তার ফোন কল রেকর্ড, ওর
যাবতীয়
তথ্য আছে।",ফাইলটা টেবিলে রাখলো সময়।
হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের সুইচ টিপলো নীল।
একজন পিয়ন আসলো রুমে।
-"কফি? "সময়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো নীল।
-"মাই প্লেজার ",সময় হাসিমুখে বললো।
-"দুই কাপ কফি পাঠিয়ে দিন।আমারটা ব্ল্যাক কফি।"
পিয়ন চলে যাওয়ার পর ফাইলটা খুললো নীল।ফোন
রেকর্ড দেখছে।
একটা নাম্বারে চোখ আটকে গেলো ওর।
এই নাম্বারে বেশি কথা বলেছে মেয়েটা।
মৃত্য যেদিন হয়েছে সেদিন রাত ১১টায়ও
কথা হয়েছে।
সময়সীমা প্রায় দেড় ঘণ্টা।
এতোক্ষণ কার
সাথে কথা বলেছে সেটা বুঝতে বাকি থাকেনা ওর।
নাম্বারটাতে পয়েন্ট করে ধরতেই সময় জানায়
শান্তার সাথে একই অফিসে চাকরী করে। ফ্রেন্ড কাম
কলিগ।
কফি চলে এসেছে।গড়ম কফির কাপে চুমুক
দিতে দিতে ভাবছে নীল।
-"এর সাথে দেখা করতে হবে। কোথায়
থাকে জানতে পেরেছো? "
-"জ্বি স্যার! উত্তরাতে থাকে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে।
সাথে একটা ফ্রেন্ডও থাকে।"
-"হুম!! এর সাথে কথা বলা দরকার। কাল
যেতে হবে একবার এর বাসায়। "
-"কিন্তু স্যার!এই মুহূর্তে ঢাকায় নেই সায়মন।"
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সময়ের দিকে তাকালো নীল।সময়
নিজেই বলে দিলো, "অফিসের কাজে ঢাকার
বাইরে আছে সায়মন।গত এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার
বাইরে। "
ছেলেটা পরিশ্রমী আছে।কাজে মনোযোগী।
মনে মনে স্বীকার না করে পারলোনা নীল।
-"ঠিক আছে। ঢাকায় আসার
সাথে সাথে দেখা করতে হবে। আর শান্তার
অফিসে একবার ঢুঁ
মারতে হবে।",কথাটা বলে চেয়ারে হেলান
দিয়ে আবার চিন্তায় ডুবে গেলো নীল।
সময় বুঝলো এখন স্যার আর কিছু বলবেন না।তাই
আস্তে করে উঠে পড়লো।
*** ***
নিজের রুমে বসে আছে নীল।
গতকাল শান্তার অফিসে গিয়েছিল।
শান্তার কলিগদের সাথে কথা বলেছে।
তাদের কাছে তেমন কিছুই জানা যায়নি।
শুধু একটা ছাড়া।
শান্তা আর সাইমন বিয়ে করতে যাচ্ছিলো।
কিছুদিন পড়েই।ব্যাপারটা শান্তার একজন কলিগ
বললো।
আর আজ শান্তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসেছে।
তাতে যা জেনেছে সেটা ভাবতে গেলে কেস
আরো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।
লাশের দুটো কিডনি নেই!
একটা আগেই নাকি ছিলনা।
তবে বোঝা যাচ্ছে কিডনিটা অপসারণ
হয়েছে বেশিদিন হয়নি।অপরটা লাশের
গা থেকে খুলে নেয়া হয়েছে।
কে এভাবে মারবে?কেন?
*** ***
ডাইনিং রুমে বসে আছে নীল।
রুমে এক কোনে সোফাসেট।মাঝখানে একটা টি-
টেবিল। আর এক কোণায় একটা টিভি।
সাধারণ কিন্তু এর মধ্যেই রুচিশীলতা আছে।
দেয়ালে পেইন্টিং ঝুলছে।
প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি।
ভালই।
সামনে বসে আছে সায়মন।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি,চেহারায় অসহায়
এবং বিব্রতভাব।
চোখে ধূর্ত চাহনি।
কিছুক্ষণ এভাবে দেখার পর জিজ্ঞেস
করলো নীল,"কেমন আছেন মি.সায়মন? "
-"জ্বি ভালো।",সায়মনের ছোট্ট জবাব।
-"নিজের হবু স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও ভালো আছেন?
",খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সায়মনকে।
-"জানেনই যখন আমার ভালো থাকার
কথা না তাহলে কেন সেটা প্রশ্ন করছেন অফিসার?
",এবার সায়মন তাকালো নীলের দিকে।
সরাসরি।
এবার সায়মন বললো, "মৃত্যুর দিন আপনার
সাথে শান্তার কথা হয়।প্রায় দেড় ঘণ্টা।ঠিক
কি বলেছিল শান্তা বলতে পারেন কি? "
-"আপনি কোথাও ভুল করছেন অফিসার। শান্তার
সাথে আমার ওইদিন কথা হয়নি।"
এবার নীলের অবাক হবার পালা।
-"আপনার নাম্বারে শান্তা ফোন দিয়েছিল। দেড়
ঘণ্টা কথাও হয়েছে। তাও বলছেন কথা হয়নি?!! "
-"সেক্ষেত্রে আপনাকে জানাতে হচ্ছে আমার,
যে আমার
ফোন আমি হারিয়ে ফেলেছি।বলতে পারেন
চুরি হয়ে গিয়েছে সেটা।"
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো নীল।
-"কবে চুরি হয়েছে? কিভাবে? "
-"কিভাবে হয়েছে আমি নিজেও জানিনা।আমার রুমেই
রাখা ছিলো মোবাইলটা।
আমি রেখে একটু বাইরে গিয়েছিলাম।
এসে দেখেছি মোবাইলটা নেই। রেজিস্ট্রেশন
করা ছিল। তাই পরে কাস্টোমার কেয়ার থেকে আবার
সিমটা তুলে নেই।"
-"কবে হারিয়েছিল মানে চুরি হয়েছিল আর ঠিক
কবে আপনি সিম নতুন করে নিয়েছেন?"
-"হারিয়েছি গত ১২তারিখে।আর সব কিছু শেষ
করে তুলেছিলাম ১৬তারিখ। "
-"আপনি তো ওইদিনই তুলতে পারতেন? তাহলে? "
-"আসলে মিটিংয়ে আটকে গিয়েছিলাম।
তাই তুলতে পারিনি।আর অন্যান্য কাজও ছিল। অন্য
সিম দিয়েই কথা বলেছি সবার সাথে।"
নীল তাকিয়ে আছে ছেলেটার চোখে।
মনে হচ্ছে সত্যিই বলছে।
-"এর মধ্যে আপনার সাথে শান্তার কথা হয়নি? "
-"হ্যাঁ।১৩তারিখ শেষ কথা হয়েছিল।এরপর ওর
সাথে কথা হয়নি। "
-"কেন? "
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকালো সায়মন।
চেহারায় দুঃখ ফুটে উঠেছে।
-"ওর সাথে আমার ঝগড়া হয়েছিল।কি বিষয়
নিয়ে সেটা বলতে চাচ্ছিনা।প্লিজ! "
নীল এবার অবাক!!
-"দেখুন যেহেতু শান্তা মারা গিয়েছে,সেহেতু কিছু
গোপন না করলেই ভালো হয়। কারণ বুঝতেই পারছেন।
তদন্তের সার্থে।"
সায়মন চুপ হয়ে আছে।
সময় নিচ্ছে।
-"ও অনেক সন্দেহপ্রবন ছিলো।
মনে করতো আমি হয়তো অন্য মেয়ের সাথে রিলেশন
বা ওই জাতীয় কিছু করি। আর তাই..... "
-"হুম! তাহলে ১৩তারিখের পর আপনার সাথে শান্তার
আর কথা হয়নি বা আপনিও যোগাযোগ করেননি? "
-"না! আসলে আমিও রেগে গিয়েছিলাম ওর ওপর। তাই
আর ওর সাথে কথা বলিনি।ভেবেছিলাম ঢাকায় এসেই
ওর সাথে সরাসরি কথা বলবো। "
নীল আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় ওর ফোন
বেজে উঠলো।
মেসেজ এসেছে।
মেসেজটা দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে উঠেছে।
একবার সায়মনের দিকে তাকিয়ে মোবাইলের
দিকে তাকালো ও।
-"এখন আমাকে উঠতে হবে। কিছুদিন আপনি ঢাকার
বাইরে যাবেননা। আশা করি শান্তার খুনিদের
ধরতে সাহায্য করবেন। "
হাত বাড়িয়ে দিলো নীল।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাতটা ধরলো সায়মন। ছোট্ট
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিলো হাতটা।
বেড়িয়ে এলো নীল।
বাইরে গাড়ি পার্ক করা আছে।
সেটাতে বসে কোথাও ফোন দিয়ে কিছু নির্দেশ
দিলো ও।
এবার গাড়ি স্টার্ট দিলো।
গন্তব্য রূপসী হোটেল।
রিসার সাথে কথা বলা দরকার।
রিসার সম্পর্কে কিছু জানতে পেরেছে নীল।তবে ওর
সাথে কথা বলার আগে শান্তার বাসার কাজের বুয়ার
সাথে কথা বলে নিয়েছে নীল।
শান্তার বাসায় এই একজনই কাজ করে।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে।ঘরের সব কাজকর্ম করে চলে যায়।
মধ্যবয়সী একজন মহিলা।
বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি।
তবে যথেষ্ট শক্তাসামর্থ।
কাঁচাপাকা চুল,চেহারায় হালকা ভাজ পড়া।হাত দুটো দেখলে বোঝা যায় পরিশ্রমী।থাকেন একটা টিনশেড ঘরে।
ঘরে জিনিশপত্র তেমন কিছু নেই।
একটা খাট,একটা পুরোনো কাঠের আলমারি,আর
হালকা জিনিশপত্র।
মহিলার সাথে কথা বলে অনেককিছুই
জানতে পারলো নীল।
শান্তার ব্যাপারে।
আর একটা কথাও জানতে পারলো।
যেটা রিসা বা সায়মন কেউই নীলকে বলেনি।
তাই এখন রিসার সাথে কথা বলতে হবে নীলের।
মনে হচ্ছে কেসটার সমাধান প্রায় হয়ে গিয়েছে।শুধু
কিছু ছেড়া সুতো জোড়া লাগাতে হবে।
*** ***
রিসার দিকে তাকিয়ে আছে নীল।
রিসা এই মুহূর্তে একটা হোটেলে আছে।
সেখানেই দেখা করতে এসেছে নীল।
কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই রিসাকে প্রশ্ন
করলো নীল,"বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন কেন?"
মাথাটা নিচু করা ছিলো রিসার।
নীলের কথা শুনে ঝট করে তাকালো ওর দিকে।
চোখে তীব্র ভয়।
নীল বললো, "মিথ্যে বলে লাভ নেই। আপনার
সম্পর্কে সব খবর নিয়েই এসেছি।এখন
সত্যটা বলে দিলে আপনারই ভালো। ",এটুকু
বলে থামলো ও।
-"বাসায় আমার বিয়ে ঠিক করেছিল। আমি এই
বিয়েতে রাজী ছিলাম না।তাই পালিয়ে ঢাকা আসি।
শান্তার বাসায় আশ্রয় নেই।ওই আমাকে চাকরীর
কথা বলে।আর আমার থাকার
ব্যাবস্থা করে দিবে এটাও বলে।",চুপ
করে গেলো রিসা।
একটা মেসেজ এলো এই
মুহূর্তে নীলের মোবাইলে।সেটা পড়া শেষ
করে রিসার দিকে তাকালো নীল।
-"শান্তার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য
হয়েছিলো নাকি আপনার? "
-"না!! ",ও খুব ভালো ছিলো। আমাকে আপন
করে নিয়েছিল।
নীল উঠে জানালার সামনে এসে দাড়ালো।
পকেটে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলো এক
দৃষ্টে।
রাস্তায় গাড়ি আসা যাওয়া করছে।
-"তবে আপনি বোধহয় আপন
করতে পারেননি শান্তাকে।
তাই না মিসেস সায়মন? "
-"কি বলছেন আপনি??!! মাথা ঠিক আছে আপনার??
আমি মিসেস সায়মন কেন হবো??
",রিসা চেঁচিয়ে উঠলো।
-"উত্তেজিত হবেননা মিসেস সায়মন। আমিই
বলছি কি হয়েছে।আপনারা একটা সুন্দর নাটক
সাজিয়েছেন।মানে আপনি আর মি.সায়মন।শান্তার
মাধ্যমে আপনাদের পরিচয় হয়।প্রথমে সব ঠিক
থাকলেও পরে হয়তো কোনো ভাবে আপনার মনে হয়
আপনি সায়মনের ওপর দুর্বল।আর অন্যদিকে সায়মনও
একই অবস্থায় পড়ে যায়।ফল হিসেবে বিয়ে করেন
আপনারা। আর সেটা জানতে পারে শান্তা ১৪তারিখ
সন্ধ্যায়। সায়মনের ড্রাইভার মোবাইলটা চুরি করে।
আর সেই জানায় সব।বলতে গেলে সায়মনের ওপর
চোখ
রাখার জন্যই ড্রাইভারকে বলেছিল শান্তা।
রাতে তাকে টানা দেড় ঘণ্টা নির্দেশ দেয় শান্তা।
খুন করবে সায়মনকে।আর আপনি সেটা শুনে ফেলেন।
তারপর সায়মনকে সতর্ক
করে দিয়ে নিজে শান্তাকে খুন করেন।
ঠিক বলেছি?",নীল তাকালো রিসার দিকে।
-"আমি শান্তাকে খুন করিনি!!!! আমি কিছু করিনি!!!!
হ্যাঁ আমি সায়মনকে ভালবাসি। ও
আমাকে ভালোবাসে। তাই আমরা বিয়ে করেছি। আর
এটার জন্য আমরা ওর কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। কিন্তু
ওকে খুন করার চিন্তা ভুলেও আমাদের মাথায়
আসেনি।"
,রিসা কাঁপছে।
রাগে না হতাশায়
বোঝা যাচ্ছেনা না।তবে নীলের ধারণা সত্যি।
-"আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি খুন করেননি?",নীল
তাকালো রিসার চোখে।
-"না!!! ওকে আমি খুন করিনি। এমনকি আমি জানিও
না কিভাবে হয়েছে এটা। ",রিসা হাপাচ্ছে।ঘন ঘন
শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। উত্তেজনার কারণে।
-"ঠিক আছে।কি হয়েছে সেটা কালই জানা যাবে। আর
আপনি এখানেই থাকবেন। যদি বাইরে কোথাও
যাওয়ার চেষ্টা করেনন তাহলে বুঝে নিবো আপনিই
খুনি।",নীল রিসার দিকে আঙ্গুল
তুলে কথাটা বলে বের হয়ে গেলো।
ফোনে নির্দেশ দিলো রিসার ওপর নজর রাখার জন্য।
সায়মনের তথ্যগুলো সত্যি ছিলো।শুধুমাত্র বিয়ের
ব্যাপারটা ছাড়া।
ড্রাইভারটা ধরা পড়েছে।
এখন জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।
*** ***
মেজাজটাটা খারাপ হয়ে আছে নীলের।
কেসটাতে এভাবে মার খাবে ভাবেনি।
রিসাকে বলেছিল যাতে ও বের না হয়।
মেয়েটা পালিয়েছে।
হোটেলে নজর রাখার পরও কিভাবে সবার
চোখকে ফাঁকি দিলো কে জানে?
রাগে নিজের মাথার চুলল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে।
পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছে সম্ভাব্য সব
জায়গায়।
মেয়েটাকে ওর চাইই চাই!!
হেরে যাওয়া শব্দটা ওর জন্য না।
নিজেও গাড়িতে করে দেখছে সব জায়গায়।
সাথে সময়ও আছে।
তবে হয়তো নীল জানেনা এই কেসে ওর জন্য
হেরে যাওয়া শব্দটাই বরাব্দ করা হয়েছে।
শেষাংশ :
ঘর্মাক্ত মুখটা শাড়ির
আঁচলে মুছে নিলো মধ্যবয়সী মহিলাটা। হাতে রক্ত
লেগে আছে।
সামনে পড়ে আছে একটা লাশ।গলা পর্যন্ত
চেরা হয়েছে। ভেতরের অন্ত্রগুলো টেনে বের করায়
হাতটা পিচ্ছিল তরল আর রক্তে ভরে আছে।
এবার কিডনিটা বের করতে হবে।
স্কালপেলটা বের করে কোমোরের ঠিক ওপরভাগের
চামড়াটা চিরে ফেললো।
আস্তে করে হাতটা ঢুকালো ভেতরে।
কিডনিটা আস্তে করে বের করে পাশে রাখা বড়
বৈয়মে রাখলো।
ফর্মালিনে ভরা সেটা।
আগের লাশটা থেকে একটা কিডনি পেয়েছিল।
আরেকটা ফেলে দিতে হয়েছিল।
ইশ!! নাহলে চারটা কিডনি পেয়ে যেতো।
তাও তিনটা পেয়েছে সেটাও কম না।
ঠিক মতো ঠিক জায়গায় পাঠালেই টাকা পেয়ে যাবে।
এবার হাতের আঙুলের দিকে চোখ গেলো তার।
অনামিকা আঙ্গুলটা কেটে নিলো ফিঙার কাটার দিয়ে।
এটা শখ বলা যায় তার।
এ পর্যন্ত ৮টা বাসায় কাজ করেছে।আর সব
জায়গা থেকেই এসব জোগাড় করেছে।
কিডনি এগুলো বিক্রি করে ভালই টাকা আয় হয়েছে।
কিন্তু ছাড়তে পারছেনা এই কাজ।
নেশা হয়ে গিয়েছে যে!!
অনামিকা আঙ্গুলটা নিয়ে ফর্মালিনে চুবিয়ে রাখলো।
এবার সব পরিষ্কার করতে হবে।
শান্তাকে মারতে যেমন বেগ পেতে হয়নি।
তেমনি একে মারতেও অসুবিধা হয়নি।
হবেই বা কেন?
পাখি যে নিজে থেকে এসেছিলো।পালাতে চেয়েছিলো।
হাঁ হয়ে থাকা মুখের
দিকে তাকিয়ে রইলো মধ্যবয়সী শক্ত-সামর্থ মহিলাটি।
মুখ থেকে বিদ্রুপাত্মক সুরে বের
হয়ে এলো দুটি শব্দ...
"বেচারি রিসা!!! "
*** সমাপ্ত****
লিখা: সাবরিনা নিহা
ফেসবুকে আমাদের পেজ
Share on Google Plus

About Nahid

    Blogger Comment
    Facebook Comment

0 comments:

Post a Comment